কালিহাতীর কুমার শিল্প: মাটির চাকা ঘুরে চলেছে শতাব্দীর গৌরব বয়ে চলছে।
গৌরাঙ্গ বিশ্বাস, বিশেষ প্রতিনিধি
শিল্প যেখানে মানুষের সত্তা ও ইতিহাসকে ধারণ করে, সেখানে কালিহাতীর কুমার শিল্প এক মহীরুহের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মাটির চাকার ঘূর্ণিতে যেমন তৈরি হয় রূপ, তেমনি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে এক অমর কাহিনি—একটি ঐতিহ্য, যা গড়ে উঠেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের নিরলস পরিশ্রমে।
ছবিতে ধরা পড়া এই শিল্পের দৃশ্য যেন মাটির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কের গল্প বলে। প্রতিটি মাটির কলস, পাতিল, থালা-বাটি, এবং দৃষ্টিনন্দন শোপিসে রয়েছে কুমারদের নিখুঁত হাতে গড়া শিল্পকর্মের ছোঁয়া। মাটি থেকে তোলা জিনিসপত্র একদিকে যেমন প্রতিদিনের জীবনের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে এটি স্থানীয় সংস্কৃতির শেকড়ের প্রতিচ্ছবি।
মাটির গন্ধে রন্ধ্রিত ঐতিহ্য
কালিহাতীর কুমার পল্লীতে প্রবেশ করলে যেন আপনি ফিরে যান সময়ের পিছনে—যেখানে মাটির তৈরি জিনিসের উপর নির্ভরশীল ছিল প্রতিটি পরিবার। এই শিল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবনের সঙ্গী হিসেবে মাটির ব্যবহারকে রূপ দিয়েছিলেন সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ শিখরে। মাটির তৈরি এসব জিনিস শুধু দরকারি পণ্যই নয়, বরং প্রতিটি জিনিসপত্র কুমারদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতার এক জ্বলন্ত প্রমাণ।
তুলার মতো নরম মাটি যখন কুমারের চাকার স্পর্শ পায়, তখন তা রূপ নেয় আকর্ষণীয় সব নকশায়। চোখ ধাঁধানো রং ও নিখুঁত কারুকাজের মাধ্যমে এই পণ্যগুলো স্থানীয় বাজারে কদর পায়। মেলা বা উৎসবের সময় এই মাটির তৈজসপত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ এক নতুন মাত্রা পায়। সেগুলো শুধু ব্যবহারের জন্য নয়, বাসা ও বাগানের শোভা বাড়াতেও সমানভাবে প্রিয়।
এক শিল্প, এক জীবন
এই মাটির শিল্প শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি এখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা, তাদের পরিচয়। কালিহাতীর প্রতিটি কুমার পরিবারের প্রতিদিনের ঘাম, শ্রম ও স্বপ্নের মিলন ঘটেছে এই চাকার সঙ্গে। তাদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি এই মাটি। যদিও আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্লাস্টিকের বিস্তারে এই শিল্প সংকটের মুখে পড়েছে, তবুও এটি তার ঐতিহ্য ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধু কুমারদের নয়, বরং আমাদের সবার। কারণ এই ঐতিহ্য আমাদের শেকড়, আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
কেন এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ
মাটির শিল্প আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিকের পণ্যের তুলনায় মাটির তৈরি পণ্য সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং সহজেই পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা যায়।
তাছাড়া, এই শিল্প স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও অপরিহার্য। বহু পরিবারের আয়-রোজগার এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। তাই এ শিল্পের টিকে থাকা মানে শুধু কুমার পরিবারের জীবিকা নয়, এটি একটি সম্প্রদায়ের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রতীক।
ভবিষ্যতের পথে
কালিহাতীর মৃৎশিল্প শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, এটি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি আশার আলো। আধুনিক ডিজাইন, নান্দনিক কৌশল এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে এই শিল্প পুনরায় বিকশিত হতে পারে। যথাযথ প্রশিক্ষণ, সরকারি সহায়তা, এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে এই ঐতিহ্যকে মেলালে এটি আবারও জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছাতে পারে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এই মাটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে যাই। যেন কালিহাতীর কুমারদের চাকা অবিরাম ঘুরতে থাকে, শতাব্দী পেরিয়ে গৌরবময় নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার পথে।